মনে করুন আপনি আপনার বন্ধুকে একটি মেসেজ পাঠিয়েছেন। কয়েক ঘন্টা হয়ে গেছে, কিন্তু কোনো উত্তর আসেনি। বেশিরভাগ মানুষ ভাববে- সে হয়তো ব্যস্ত আছে।
কিছু মানুষ বিষয়টা অন্যভাবে নেয়। তারা ভাবে- সে নিশ্চয় আমাকে অপছন্দ করে৷ কিংবা আমি হয়তো কোনো আচরণে বন্ধুত্বটা নষ্ট করে ফেলেছি।
এই অতিরঞ্জিত এবং তীব্র আবেগ তাদেরকে অসুস্থ করে ফেলে। মানসিকভাবে তারা ভেঙে পড়ে। এর নাম- রিজেকশন সেনসিটিভিটি ডিসফোরিয়া। চিন্তা করে দেখুন তো আপনিও এই দলে পড়েন কিনা।
এটা আলাদা কোনো মানসিক রোগ না৷ কিন্তু বর্তমানে এটা গুরুত্ব পাচ্ছে বেশ৷
•
প্রত্যেক ব্যক্তিই সমালোচনা বা উপেক্ষা পেলে খারাপ অনুভব করেন। কিন্তু আরএসডি হলো এর চেয়েও গভীর কিছু।
আরএসডি-তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সামান্য মন্তব্য বা মজার ছলের অবহেলাকেও চরম অপমান, লজ্জা কিংবা আত্মসন্দেহ হিসেবে গ্রহণ করেন।
কেউ যদি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম তুমি এটা এভাবে করবে’—এমন কথাতেই তাদের মাঝে তীব্র আবেগের সাড়া তৈরি হতে পারে। ফলে অনেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন, অতিরিক্তভাবে দুঃখপ্রকাশ করেন বা আত্মরক্ষার্থে রাগের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখান।
•
এটি কোনো ব্যক্তিত্বগত দুর্বলতা নয়, এটি হলো মস্তিষ্কের কার্যকারিতার পার্থক্য।
কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুনীরা এই সমস্যায় বেশি আক্রান্ত৷ এজন্য খুব ছোটখাটো বিষয়কে সিরিয়াসলি নিয়ে এরা ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে৷ প্রাপ্তবয়স্করাও এই সমস্যায় পড়ছে৷ এজন্য গঠনমূলক সমালোচনাকেও তারা নিজেদের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা ও অপমান হিসেবে অনুভব করেন। এজন্য অফিসের কলিগ বা বন্ধু্বান্ধবরা ঠাট্টার ছলে কিছু বললে তারা ভীষণ সিরিয়াসলি নেয়, রাতের পর রাত ঘুম হয়না ওইসব ভেবে। অথচ সেটা তখনই হেসে উড়িয়ে দেয়ার বা ভুলে যাওয়ার কথা ছিল৷
•
আপনি যদি আপনার ভেতর আরএসডি লক্ষণগুলো অনুভব করেন, তাহলে জেনে রাখুন—আপনি শুধু একা নন, অনেকেই এ সমস্যায় ভুগছেন। ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই। কিছু কৌশলের মাধ্যমে আপনি এই সমস্যা থেকে উৎরাতে পারবেন।
১. আপনি ভাবতে চেষ্টা করুন- এটা আরএসডির সমস্যা, সিরিয়াস কিছু না। আপনি যতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন ব্যাপারটাকে, সেরকম কিছুই না।
২. ধীরে শ্বাস নিন, উল্টোভাবে ১০ থেকে ১ পর্যন্ত গুনতে হবে। গোনা বা বাইরে গিয়ে দাঁড়ানো— এসব শরীরকে স্থির করতে সাহায্য করে। গবেষণায় প্রমাণিত, গভীর শ্বাস নেওয়া এবং ইন্দ্রিয়-ভিত্তিক গ্রাউন্ডিং কৌশল নার্ভাস সিস্টেমকে শান্ত করে, পরিষ্কারভাবে ভাবতে সহায়তা করে।
৩. আরএসডি সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা ঘটনার পর নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে অনেক গল্প বা কাহিনী বানিয়ে ফেলেন, যা তাদের মানসিক অবস্থার অবনতির জন্য দায়ী। এইসব গল্প বানাবেন না৷ আমাদের মস্তিষ্ক তিলকে তাল বানাতে ওস্তাদ। একবার গল্প বানাতে শুরু করলে সেই গল্প ডালপালা মেলে বটগাছ হবে৷ মানুষের প্রতি অতিরিক্ত সন্দেহ জন্মাবে, অবিশ্বাস জন্মাবে৷ এজন্য প্রথম কাজ হলো গল্প বানানো বন্ধ করা৷
৪. বেশি জটিলতায় ভুগলে এডিএইচডি ও আরএসডি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বা মনোবিশেষজ্ঞের কাছ থেকে থেরাপি নিতে পারেন।
৫. এডিএইচডি আক্রান্ত শিশুদের আবেগের ভাষা, সীমানা নির্ধারণ ও সহনশীলতা শেখানো গেলে ভবিষ্যতের আরএসডি হালকাভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব। বাবা-মা শিশুদের ভালো বিকাশের জন্য ‘রেইজিং চিলড্রেন নেটওয়ার্ক’ ‘দ্য হোল-ব্রেন চাইল্ড’ বা সহায়ক বাংলা কোনো বই পড়তে পারেন।
৬. আপনি যদি এডিএইচডি আক্রান্ত কারো সঙ্গে থাকেন বা কাজ করেন, তাহলে স্পষ্ট, নরম ও সদয়ভাবে কথা বলুন। ঠাট্টা বা অস্পষ্টতা এড়িয়ে চলুন।
________________
রিজেকশন সেনসিটিভিটি ডিসফোরিয়া কোনো দুর্বলতা নয়। এটি মস্তিষ্কের আবেগ ও সামাজিক সংকেত প্রসেস করার এক ভিন্ন ধরন। যথাযথ বোঝাপড়া, সঠিক কৌশল এবং সহানুভূতির মাধ্যমে এটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব এবং জীবন আরও সহজ ও আনন্দময় করে তোলা যায়।
_________________
যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে পরিমার্জিত।
0 Comments